সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ

প্রকাশিত: সোমবার, মার্চ ২৭, ২০২৩

নাগরিক সংবাদ ডেস্কঃ দেশের সড়ক-মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হচ্ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়, যার জন্য দায়ী করা হয় যানটির বেপরোয়া গতিকে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে ‘খসড়া মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালা’ তৈরি করা হয়। এই নীতিমালা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসন্তোষ জানানোর পর তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা, মোটরসাইকেলের নিরাপদ ব্যবহার ও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ (স্পোর্টির বদলে স্কুটি) মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান করা এবং মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোতে নীতিমালাটি করা হয়। এতে শহরের মধ্যে মোটরসাইকেলের সর্বোচ্চ গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করা, মহাসড়কে মোটরসাইকেলে আরোহী বহন না করা এবং ১২৬ সিসি ইঞ্জিনের নিচে বাইক চলাচল নিষিদ্ধ করাসহ এতে আরও বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে।এ নিয়ে মোটরসাইকেল-চালকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতিবাদের মধ্যেই নীতিমালা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২১ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে তিনি এ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সড়কে যেমন গাড়ি চলে, তেমনি মোটরসাইকেলও চলাচল করে থাকে। এই বাহনে করে মানুষ দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করেন। ফলে মোটরসাইকেলের গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হলে চালকদের নিরুৎসাহিত করা হবে।’ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালাটি সংশোধনের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে সরকারের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এই বিভাগের যুগ্ম সচিব আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের কমিটি খসড়া নীতিমালাটি তৈরি করে। এতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতর ও পুলিশের প্রতিনিধিরা রয়েছেন।

কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, খসড়া নীতিমালা তৈরি করতে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা সে অনুযায়ী খসড়াটি প্রস্তুত করেছেন। নিয়মমাফিক ওয়েবসাইট ও পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। পাবলিকলি ওপেন হওয়ার পর যেসব মতামত আসবে, তা বিবেচনায় নিয়ে এটি চূড়ান্ত করা হবে। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে নীতিমালাটি চূড়ান্ত হতে সময় লাগবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেছেন, যেহেতু সরকারপ্রধান মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালার খসড়া নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে নীতিমালাটি সংশোধন করা হবে। সংশোধনের জন্য খসড়াটি আবার কমিটির কাছে পাঠানো হবে, নাকি সংশ্লিষ্টরা সংশোধন করবেন, এটি এখনও ঠিক হয়নি। তবে এ বিষয়ে শিগগিরই উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির অপর একজন সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক শাহনেওয়াজ হাসনাত-ই-রাব্বি বলেন, ‘শহরে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নিয়ে কিছু বলা নেই। মহাসড়কে এ ক্ষেত্রে ৮০ কিলোমিটারের কথা বলা আছে। সে জন্য মূলত জাতিসংঘের একটি ঘোষণার আলোকে মোটরসাইকেল নীতিমালায় শহরাঞ্চলে সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিলোমিটার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

তার মতে, মোটরসাইকেল নীতিমালায় শহরের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে—অন্যান্য যানবাহনের গতিসীমা বেঁধে না দেওয়ায় সমস্যায় পড়বেন বাইকচালকরা। এই জটিলতার একটা সমাধান হতে পারে— এখানে চলাচল করা সব গাড়ির গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে দেওয়া। তাহলে আর গতির ভিন্নতা থাকবে না, বাইকারদেরও সমস্যা হবে না। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, নীতিমালাটি কীভাবে সংশোধন করা হবে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

নীতিমালায় আরও যা রয়েছে

‘মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালার’ খসড়ায় আরও যেসব প্রস্তাব রয়েছে হলো—রাইড শেয়ারিংয়ের সময় চালককে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত পোশাক ও নির্দিষ্ট রঙের হেলমেট পরতে হবে। অন্তঃসত্ত্বা নারী, প্রবীণ ও ১২ বছরের কম বয়সী কাউকে মোটরসাইকেলে আরোহী করা যাবে না। ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে বা মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বাইক চালানো যাবে না, বলেও বিধানে উল্লেখ হয়েছে।

ক্যারিয়ার ছাড়া অনিরাপদ ও ভারসাম্যহীনভাবে মোটরসাইকেলে মালামাল বহন করা যাবে না। যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়—এমন স্থানে মোটরসাইকেল পার্কিং করা যাবে না। মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত হ্যান্ডবিল, লিফলেট, পোস্টার, স্টিকার প্রস্তুত করে বিতরণের ব্যবস্থা করবে। তারা সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার করবে। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়মিত কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।

ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, দুর্গাপূজা ইত্যাদি পার্বণের আগে ও পরে মোট ১০ দিন জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো যাবে না। মহাসড়কে সর্বনিম্ন ১২৬ সিসি ইঞ্জিন বা সমতুল্য ক্ষমতার (‘ল’ সিরিজ) মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে। অর্থাৎ মহাসড়কে ১২৬ সিসি ইঞ্জিন বা সমতুল্য ক্ষমতার চেয়ে নিম্ন ক্ষমতার কোনও মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না।

মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালনাকালে চালক কোনও আরোহী বহন করতে পারবে না। চালককে নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি (চেস্ট গার্ড, নি গার্ড, এলবো গার্ড, গোড়ালি ঢাকা জুতা বা কেডস, সম্পূর্ণ আঙুল ঢাকা গ্লাভস এবং ফুলপ্যান্ট, ফুল শার্ট) ব্যবহার করতে হবে। হালনাগাদ বৈধ কাগজপত্র (ড্রাইভিং লাইসেন্স, রেজিস্ট্রেশন সনদ, ট্যাক্স-টোকেন ইত্যাদি) এবং রেট্রো-রিফ্লেক্টিভ নম্বরপ্লেট ও আরএফআইডি ট্যাগ ছাড়া মোটরসাইকেল চালানো যাবে না।

মোটরসাইকেল চালনাকালে চালক ও আরোহী উভয়কেই সঠিকভাবে বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত হেলমেট পরতে হবে। মহাসড়কে চলাচলের জন্য মোটরসাইকেলে এবিএস (এনটি লক ব্রেকিং সিস্টেম) থাকতে হবে। মোটরসাইকেল বাঁ লেনে চালাতে হবে, ফুটপাতে চালানো যাবে না। বৃষ্টির সময় অতি সহজে থামানো যায়, এমন নিয়ন্ত্রণ উপযোগী ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালাতে হবে। মোটরসাইকেল চালনাকালে হঠাৎ গতি বাড়ানো, থামানো বা দ্রুত মোড় নেওয়া যাবে না।

কুয়াশায় লো-বিম বা ডিপার জ্বালিয়ে সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ উপযোগী ধীরগতিতে মোটরসাইকেল চালাতে হবে। দৃষ্টিসীমা বেশিমাত্রায় কমে গেলে বা একেবারেই দেখা না গেলে, মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করতে হবে। মোটরসাইকেল চালনাকালে নির্ধারিত গতিসীমা মেনে চলতে হবে। রাতে মোটরসাইকেল চালনাকালে রেট্রোরিফ্লেক্টিভ জ্যাকেট ব্যবহার করতে হবে এবং মোটরসাইকেল চালনাকালে ফার্স্ট এইড কিট বহন করতে হবে।

নীতিমালায় স্কুটির প্রসার ঘটানো এবং স্পোর্টির ব্যবহার কমানোর কথা বলা হয়েছে। ‘স্পোর্টি মোটরসাইকেল’ বলতে দ্রুতগতির বাইককে বোঝানো হয়েছে, যেটির আসন গতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার সুবিধার্থে কিছুটা কৌণিকভাবে তৈরি। ‘স্কুটি মোটরসাইকেল’ হচ্ছে—আরামদায়ক, জ্বালানি সাশ্রয়ী, অপেক্ষাকৃত কম গতির এবং সহজে নিয়ন্ত্রণ উপযোগী, যার আসন সাধারণত ভূমির সমান্তরাল। সে জন্য দুর্ঘটনা কমাতে মোটরসাইকেল উৎপাদন, সংযোজন, আমদানি পর্যায়ে স্কুটি জনপ্রিয় করতে শুল্ক সুবিধা কমানো এবং স্পোর্টির শুল্ক বৃদ্ধি করা। ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করতে স্কুটি ব্যবহারের সুফল উল্লেখ করে প্রচারণা চালানো হবে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৬ হাজার ৮২৯টি। এতে নিহত হন ৭ হাজার ৭১৩ জন। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৩ হাজার ৯১ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বেড়েছে বলেও জানায় সংগঠনটি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭ বছরে ৩৭ হাজার ৪২২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১ হাজার ৬৬৫ জন নিহত এবং এক লাখ ৩৯৭ জন আহত হয়েছেন। গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ২০২২ সালে। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ৯৫১ জন নিহত হয়েছেন।

মোটরসাইকেল চলাচল নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে—বেপরোয়া প্রতিযোগিতার মনোভাব, গতি বাড়ানোর প্রবণতা, মোটরসাইকেলের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা না থাকা, আইন পালনে অনীহা, মোবাইল ফোন ব্যবহার ইত্যাদি কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেশি হয়। সেজন্য মোটরসাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস, মোটরসাইকেলের নিরাপদ ব্যবহার ও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ বাইক ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া এবং মোটরসাইকেল চালকের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।

রোড সেফটির নির্বাহী পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ও যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, মোটরসাইকেলের সঙ্গে গতির এক ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। যানজট থেকে বাঁচতে, দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে এই বাহনে ছুটে চলছে অনেকে। বিভিন্ন কোম্পানি রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে যাত্রীসেবা দিচ্ছে। অনেকে ব্যক্তিগত বাইক ব্যবহার করছেন। মূলত গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলার কারণে মানুষ বাইকমুখী হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে।

তারা বলছেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বাইক কোম্পানিগুলোর বেপরোয়া গতিরোধের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করা উচিত। সড়কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বাড়াতে হবে। মোটরসাইকেলের কেনাবেচা থেকে শুরু করে রাস্তায় চলাচলের প্রতিটি পর্যায়ে স্বচ্ছতা আনতে হবে। এসব ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

অন্যদের সাথে শেয়ার করুন

আরো পড়ুন