মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

একসঙ্গে বেশি পণ্য কেনায় নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়

প্রকাশিত: সোমবার, মার্চ ২৭, ২০২৩

নাগরিক সংবাদ ডেস্কঃ সরকারের বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বারবার জানাচ্ছেন, চলতি রমজানে দেশে কোনও ধরনের নিত্যপণ্যের সংকটের কোনও শঙ্কা নেই। তাই একসঙ্গে বেশি পণ্য কেনার প্রয়োজন নেই। পণ্যের কোনও ঘাটতি নেই, সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু বাস্তবের চিত্র ভিন্ন। কে শুনছে কার কথা! যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা মরিয়া হয়ে ভোগ্যপণ্য কিনেছেন, এখনও কিনছেন। ফলে রোজার শুরুতেই নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে ক্রেতাদের এমন আচরণকেও দায়ী করা হচ্ছে।

বাজার মনিটরিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকেই যদি একসঙ্গে এক মাসের বাজার করেন, তাহলে বাজারের স্বাভাবিক সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে। ৩০ দিনের পণ্য একদিনে কিনলে বাকি ২৯ দিন ওই সব পণ্যের সরবরাহ ঠিকমতো জোগান দেওয়া যায় না। সরবরাহে বিপত্তি ঘটে। চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের সামঞ্জস্য না থাকলে পণ্যের দামে প্রভাব পড়ে। সেই প্রভাব সবসময়ই নেতিবাচক। কারণ, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে পণ্যের দাম কমে যায়। এতে বিক্রেতা বা উৎপাদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেলে পণ্যের দাম বাড়ে। এতে ক্রেতা ক্ষতির মুখোমুখি হন।

সরবরাহের এই প্রবাহের দিকে তাকিয়ে থেকে একশ্রেণির মুনাফাখোর ব্যবসায়ী। যারা সুবিধা লোটার সুযোগ খোঁজে। বাজারে যখন স্বাভাবিক সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি সৃষ্টি হয় তখনই এই শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে কাজটি করে ফেলে। বাজার হয়ে ওঠে অস্থির। দাম বাড়ে প্রতিটি পণ্যের। সামর্থ্যবান ক্রেতাদের এই আচরণে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানীর পাইকারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা জানিয়েছেন, আমরা প্রতিদিন মিলগেট থেকে পণ্য এনে বাজারে সরবরাহ করি। মিলগেট থেকে প্রতিদিনের পণ্য প্রতিদিন, আবার প্রতি সপ্তাহের পণ্য প্রতি সপ্তাহে সরবরাহ করি। এক সপ্তাহের জন্য সরবরাহকৃত পণ্য যদি ক্রেতারা একদিনে কিনে নিয়ে যায়, তাহলে বাজারে সপ্তাহের অন্যদিন বিক্রি করার পণ্য পাবেন কোথায়? সেখানে বাজারে এক ধরনের সংকট তৈরি হবে। সেই সংকটকে কেন্দ্র করে বাজার অস্থির হলে তার দায় তো ক্রেতাদেরই নিতে হবে। এ জন্য আমরাও ক্রেতাদের বলেছি, বাজারে পণ্যের কোনও ঘাটতি নাই। তাই ক্রেতারা যেন একসঙ্গে বেশি করে পণ্য কিনে ঘরে মজুত না করেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, ভোক্তা সাধারণ নিজ দায়িত্বে একসঙ্গে বেশি বা একমাসের পণ্য না কিনলে বাজারে পণ্যের ওপর কোনও চাপ পড়বে না। কৃত্রিম উপায়ে কোনও পণ্যের সংকট সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে অবৈধ মজুত করার চেষ্টা করা হলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে বাজারে নজরদারি এবং মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের প্রচারমাধ্যমও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে। আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে ভোক্তার অধিকার রক্ষা করা সহজ হবে। সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার জন্য।

তিনি বলেছেন, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেশি। সে কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম কিছুটা বেড়েছে। দেশের নিম্ন আয়ের মানুষকে সহায়তা করার জন্য সরকার দেশের এক কোটি পরিবারকে পারিবারিক কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় করছে। ভোক্তা সাধারণ সংযমী হলে কোনও ব্যবসায়ী বেশি লাভের সুযোগ নিতে পারবে না। তিনি রমজানে ক্রেতাদের সংযমী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, অনুরোধ করেছেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, রমজান মাসে বাজার মনিটরিং সবসময়ই জোরদার থাকবে। সঠিক মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের বিষয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোকে সতর্ক করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। ভোক্তাকে পণ্য বিক্রয়ের রসিদ দিতে হবে। রসিদ না দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে ভোক্তা অধিকার আইনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শুক্রবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়া বাজারে রমজানের বাজার করতে আসা ব্যাংক কর্মচারী সোহরাব হোসেন বলেন, আমাদের সংসারের বাজার করার সময় খুবই কম। তাই যখনই সময় পাই তখনই সম্ভব হলে কিছুটা বেশি করে বাজার করার চেষ্টা করি। এ ছাড়াও রমজানে আমাদের দেশের বাজারের পরিস্থিতি কারও নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে মনে হয় না। তাই সম্ভব হলে সামর্থ্য থাকলে পুরো রোজার বাজারটাই করে রাখার চেষ্টা করি।
এদিকে কাওরানবাজারের ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন জানিয়েছেন, কিছু ক্রেতা তো রয়েছেন তারা পুরো মাসের বাজার একসঙ্গে করেন। এতে বাজার এক ধরনের চাপ অনুভব করে। বাজারে চাহিদা থাকলেও পণ্যের সরবরাহ কমে যায়। সেই চাপের কারণেই বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতির সুযোগ কোনও কোনও ব্যবসায়ী নেবে এটাই তো স্বাভাবিক। বাজারের সব ব্যবসায়ী তো সমান নয়। এটা মনে রাখতে হবে। এ জন্য সরকার, ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই সমান দায়িত্ব থাকা উচিত। সবারই সংযমী হওয়া উচিত।

এদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ডাল, ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যের ক্ষেত্রেই কোনও ঘাটতি নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, ভোজ্যতেলের বাৎসরিক চাহিদার পরিমাণ ২০ লাখ টন। প্রতিমাসে প্রায় এক দশমিক চার লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকলেও রমজানে বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ টন। বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপের কাছে বর্তমানে মজুত আছে দুই লাখ ৭৫ হাজার ১৮৭ টন। পাইপলাইনে আরও আছে দুই লাখ ৪২ হাজার টন। রমজানে চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেলের মজুত কম আছে ২৪ হাজার টন। তবে পাইপলাইনে থাকা ভোজ্যতেল দেশে পৌঁছলে ঘাটতি থাকবে না।

দেশে বাৎসরিক চিনির চাহিদার পরিমাণ ২০ লাখ টন। প্রতিমাসে দেড় লাখ টন চিনির চাহিদা থাকলেও রমজানে চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় তিন লাখ টন। দেশে বর্তমানে মজুত আছে দুই লাখ ৫০ হাজার ৭৪৯ দশমিক ৬৮ টন। এ ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি থাকলেও পাইপলাইনে থাকা চিনি আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি মোকাবিলা সম্ভব।

রমজান মাসকে ঘিরে বিপুল পরিমাণ ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, দেশে খেজুরের বাৎসরিক চাহিদা এক লাখ টন। শুধু রমজানেই এর চাহিদা ৫০ হাজার টন। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত খেজুর আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪৬ হাজার ৩৭৬ টন। এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ২৩ হাজার ৮২৬ টন।

জানা গেছে, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে কমপক্ষে ১০টি সংস্থা মাঠে নামানো হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল। র‌্যাব-পুলিশের পৃথক ভ্রাম্যমাণ আদালত, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, টিসিবি, কৃষি বিপণন অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম প্রভৃতি। এসব সংস্থাকে অবশ্যই সমন্বিত ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।

অন্যদের সাথে শেয়ার করুন

আরো পড়ুন